মহান বিজয় দিবসের ইতিহাস এবং অজানা কিছু কথা

মহান বিজয় দিবসের ইতিহাস এবং অজানা কিছু কথা। ১৯৭১ সালে সংঘটিত তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের সশস্ত্র সংগ্রাম, যার মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হিসাবে পৃথিবীর মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি নিধনে ঝাঁপিয়ে পড়লে একটি জনযুদ্ধের আদলে মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা ঘটে। ২৫ মার্চের কালো রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী। ঢাকায়় অজস্র সাধারণ নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, পুলিশ ও ই.পি.আর.-কে হত্যা করে এবং ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাপ্রাপ্ত দল আওয়ামী লীগ প্রধান বাঙালিদের তৎকালীন জনপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেফতারের পূর্বে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।

 

পরিকল্পিত গণহত্যার মুখে সারাদেশে শুরু হয়ে যায় প্রতিরোধযুদ্ধ; জীবন বাঁচাতে প্রায় ১ কোটি মানুষ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর), ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ, সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্য এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী সাধারণ মানুষ দেশকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর কব্জা থেকে মুক্ত করতে কয়েক মাসের মধ্যে গড়ে তোলে মুক্তিবাহিনী। গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ চালিয়ে মুক্তিবাহিনী সারাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক সাহায্য লাভ করে। ডিসেম্বরের শুরুর দিকে যখন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে, তখন তারা মুক্তিবাহিনীর কাছে পরাজয়ের লজ্জা এড়াবার জন্য এবং মুক্তিযুদ্ধকে আন্তর্জাতিক সংঘর্ষে পরিণত করার উদ্দেশ্যে ৩ ডিসেম্বর ভারতে বিমান হামলার মাধ্যমে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়।

 

ডিসেম্বরের শুরুতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণের মুখে ইতোমধ্যে পর্যদুস্ত ও হতোদ্যম পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তারা ৯৩,০০০ হাজার সৈন্যসহ আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেন। এরই মাধ্যমে নয় মাস ব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের অবসান ঘটে; প্রতিষ্ঠিত হয় বাঙালি জাতির প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ।

 

৯ ডিসেম্বর এক বার্তায় গভর্নর মালিক পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতিকে জানান, ‘সামরিক পরিস্থিতি নাজুক হয়ে পড়েছে। পশ্চিমে শত্রু ফরিদপুরের কাছে চলে এসেছে এবং পূর্বে লাকসাম ও কুমিল্লায় আমাদের বাহিনীকে পাশ কাটিয়ে মেঘনা নদীর ধারে পৌঁছেছে। বাইরের সাহায্য যদি না আসে, তবে শত্রু যেকোনো দিন ঢাকার উপকণ্ঠে পৌঁছে যাবে। পুনরায় আপনাকে বলছি, আশু যুদ্ধবিরতি ও রাজনৈতিক সমাধানের কথা বিবেচনা করুন।’ এরপর ১০ ডিসেম্বর গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ও মুখ্য সচিব পশ্চিম পাকিস্তানি কর্মকর্তা মুজাফফর হোসেন ক্যান্টনমেন্টে জেনারেল নিয়াজির সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেন এবং ঢাকায় জাতিসংঘের প্রতিনিধির কাছে ‘আত্মসমর্পণের’ আবেদন হস্তান্তর করেন।

 

এই আবেদনে আরো লেখা ছিল, ‘যেহেতু সংকটের উদ্ভব হয়েছে রাজনৈতিক কারণে, তাই রাজনৈতিক সমাধান দ্বারা এর নিরসন হতে হবে। আমি তাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতির দ্বারা অধিকারপ্রাপ্ত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ঢাকায় সরকার গঠনের জন্য আহ্বান জানাই। আমি শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যবস্থা নেয়ার জন্য জাতিসংঘকে আহ্বান জানাই।

 

’ এই আবেদন ঢাকায় জাতিসংঘের প্রতিনিধি পল মার্ক হেনরির হাতে দেওয়া হয়। পাকিস্তানি মহলে বার্তাটি মালিক-ফরমান আলী বার্তা হিসেবে পরিচিতি পায়। পরদিন তা আবার প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।

 

মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সৈন্যরা ঢাকা ঘেরাও করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণ করার জন্যে আহবান করে। মিত্রবাহিনী কর্তৃক গভর্নর হাউজে (বর্তমান বঙ্গভবন) বোমাবর্ষণের কারণে গভর্নর মালিকের নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের পুতুল সরকারও ইতোমধ্যে পদত্যাগ করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (বর্তমান হোটেল শেরাটন) আশ্রয় নেয়। সময় থাকতে শান্তিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণের আহবান জানিয়ে আকাশ থেকে অনবরত প্রচারপত্র ফেলা হতে থাকে।

 

অবশেষে নিয়াজির অনুরোধে ১৫ ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে পরদিন সকাল সাড়ে নয়টা পর্যন্ত ভারতীয় বিমান আক্রমণ স্থগিত রাখা হয়। পরদিন সকালে বিমান আক্রমণবিরতির সময়সীমা শেষ হওয়ার কিছু আগে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী জাতিসংঘের প্রতিনিধি জন কেলির মাধ্যমে ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষকে অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির সময়সীমা আরও ছয় ঘণ্টার জন্য বাড়িয়ে দিয়ে ভারতের একজন স্টাফ অফিসার পাঠানোর অনুরোধ জানান যাতে অস্ত্রসমর্পণের ব্যবস্থাদি স্থির করা সম্ভব হয়।

 

এই বার্তা পাঠানোর কিছু আগে অবশ্য ভারতীয় মেজর জেনারেল নাগরার বাহিনী কাদের সিদ্দিকীর মিলিশিয়া বাহিনীকে সঙ্গে করে মিরপুর সেতুতে হাজির হন এবং সেখান থেকে নাগরা নিয়াজিকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান। নিয়াজির আত্মসমর্পণের ইচ্ছা ব্যক্ত হওয়ার পর সকাল ১০:৪০ মিনিটে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে নাগরার বাহিনী ঢাকা শহরে প্রবেশ করে।

 

পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের দলিল এবং সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাদি চূড়ান্ত করার জন্য ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের চীফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জ্যাকব মধ্যাহ্নে ঢাকায় এসে পৌঁছান। বিকেল চারটার আগেই বাংলাদেশ নিয়মিত বাহিনীর দুটি ইউনিটসহ মোট চার ব্যাটালিয়ন সৈন্য ঢাকায় প্রবেশ করে। সঙ্গে কয়েক সহস্র মুক্তিযোদ্ধা। ঢাকার জনবিরল পথঘাট ক্রমে জনাকীর্ণ হয়ে উঠতে শুরু করে ‘জয় বাংলা’ মুখরিত মানুষের ভিড়ে।

 

বিকেল চারটায় ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান ও ভারত-বাংলাদেশ যুগ্ম-কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা, বাংলাদেশের ডেপুটি চীফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন আব্দুল করিম খোন্দকার এবং ভারত

 

বিজয় দিবসের বিশেষ পোষ্টঃ

‘একটি বাংলাদেশ, তুমি জাগ্রত জনতার/ সারা বিশ্বের বিস্ময়, তুমি আমার অহংকার…।’

 

একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাক, ২৫ মার্চ কালরাতের পর জাগ্রত জনতার গর্জে ওঠা; তারপর ৯ মাসের রক্তস্নাত সংগ্রাম শেষে ১৬ ডিসেম্বর বাংলার আকাশে বিজয়ের লাল সূর্যোদয়-সত্যিই এ এক বিস্ময়। এ এক অহংকার। আজ সেই বিজয়ের দিন। এই দিন গোটা বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখেছে পৃথিবীর মানচিত্রে একটি নতুন দেশের অভ্যুদয়; রচিত হয়েছে বাঙালি জাতির বীরত্বের অধ্যায়। সেই মহান বিজয়ের আজ ৪৩ তম বার্ষিকী।

 

১৬ ডিসেম্বর শুধু বিজয় উৎসবের নয়, বিজয় অক্ষুণ্ন রাখার শপথেরও দিন। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ৪৩তম বার্ষিকীতে জয়ের আনন্দ ও স্বজন হারানোর বেদনা মিশ্রিত অনুভূতি নিয়ে জাতি আজ উদ্যাপন করছে মহান বিজয় দিবস। বাঙালির ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। একাত্তরের এই দিনে দামাল মুক্তিযোদ্ধা আর মুক্তিপাগল মানুষের যূথবদ্ধ প্রতিরোধ-লড়াইয়ে র মুখে উধাও হয়েছিল পাকিস্তানি বর্গিরা। ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল এ বিজয়, প্রিয় স্বাধীনতা।

 

১৬ ডিসেম্বর একরাশ সোনালি স্বপ্ন হৃদয়ে ধারণের দিন।

 

বিজয় দিবসের তাৎপর্য

বিজয় দিবসের তাৎপর্য সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার মহান মন্ত্রের উচ্চারণে যেমন ফ্রান্সের রাজনৈতিক আকাশে সূচনা হয়েছিল প্রলয়ঙ্করী ঝড়ের; সাম্য, স্বাধীনতা ও স্বাচ্ছন্দ্যের অন্বেষণের স্বতঃস্ফূর্ত দাবি যেমন আমেরিকার ব্রিটিশ কলোনিগুলোকে উদ্বুদ্ধ করেছিল স্বাধীনতার সংগ্রামে- তেমনি সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়পরায়ণতার নিশ্চয়তা বিধানের দাবি বাংলাদেশের জনগণকে উদ্দীপ্ত করেছিল। বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র রূপে প্রতিষ্ঠার জীবনমরণ সংগ্রামে আত্মনিবেদনে। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলে ঘোষিত স্বাধীনতা সনদে তারই অনুরণন পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।

 

এই জাতির বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। মুক্তিযোদ্ধা তথা সমগ্র জনসমষ্টির সফলতা ও গৌরবের মাস এটি। আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গৌরবদীপ্ত অধ্যায় রচিত হয়েছে এ মাসেই। তাই ডিসেম্বরে পা দিয়ে সবাই আমরা অনুভব করি শক্ত মাটির স্পর্শ। লাভ করি এক অনির্বচনীয় আত্মবিশ্বাস। এক অনিন্দ্য সুন্দর আত্মশ্লাঘা।

 

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অর্জন এই জাতির শ্রেষ্ঠতম অর্জন। মাত্র কিছুসংখ্যক বিপথগামী ছাড়া সবাই এজন্য সংগ্রাম করেছেন। সহ্য করেছেন সীমাহীন যন্ত্রণা। কিন্তু লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ়সঙ্কল্প ছিলেন সবাই। তাই অতি অল্প সময়ের মধ্যে এত বড় অর্জন সম্ভব হয়েছে। বৃহৎ অর্জনের জন্য ঐক্যবদ্ধ জাতীয় উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই।

 

এমন বৃহৎ অর্জনের পরেও কিন্তু জাতি সেই ঐক্য ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। মাত্র চার দশকের মধ্যেই জাতীয় ঐক্য খণ্ডছিন্ন হয়েছে। জাতীয় লক্ষ্যও অস্পষ্ট হয়েছে। জাতীয় সংস্কৃতির প্রাণশক্তি আজ ক্ষয়িষ্ণু। দুর্যোগে অনেকটা ম্রিয়মান। জাতিশক্তির যে অমিত তেজ বিন্ধ্যাচল টলিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল তা অনেকটা চলচ্ছক্তিহীন, নিশ্চল। কিন্তু কেন এমন হলো?

 

সাম্প্রতিক কালে কিছু কিছু কথা প্রচলিত হয়েছে। ‘স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি’ তেমনি একটি বাক্যাংশ। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ তেমনি আর একটি। জোরেশোরে প্রচারিত হচ্ছে একটি বিশেষ মহল থেকে। একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য সামনে রেখে। ডিসেম্বর মাসে এসবের প্রচার যেন আর একটু বেশি। সরকার নিয়ন্ত্রিত টেলিভিশন ইদানীং অনেকেই দেখেন না। যারা মাঝে মধ্যে খোলেন তাদেরও কান ঝালাপালা এই ধরনের অপপ্রচারে। কিন্তু স্বাধীনতার বিপক্ষে তো কোনো শক্তি ছিল না। তখনো ছিল না, এখনো নেই। তখন কিছুসংখ্যক চিহ্নিত ঘৃণ্য নরাধম মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছিল বটে; কিন্তু ‘শক্তি’ বলতে যা বোঝায় তা তখনো তাদের ছিল না।

 

ঐসব বিভ্রান্ত, স্বার্থপর, পলায়নপর, কাপুরুষদের ‘স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি’ বলে তখন কেউ তাদের চিহ্নিতও করেননি। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ সম্পর্কেও একই কথা। এত কোনো ব্যক্তির চেতনা নয়, নয় কোনো গোষ্ঠীর চেতনা। নয় কোনো দলের চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়েছিল সমগ্র জাতি, ধর্ম-বর্ণ-বিশ্বাস নির্বিশেষে। এই চেতনা আত্মপ্রতিষ্ঠার। আত্মনির্ভরশীলতার। আত্মবিশ্বাসের। মর্যাদাসম্পন্ন জীবনব্যবস্থার। বলিষ্ঠ জীবনবোধের। ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়পরায়ণতা’ যা ১০ এপ্রিলে ঘোষিত ঐতিহাসিক স্বাধীনতাসনদের মূল কথা, যা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণপণে উদ্বুদ্ধ করে।

 

এখন সেই চেতনা বিকৃতির কবলে পড়েছে। কোনো কোনো প্রচারক বলে থাকেন, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেই মুক্তিযোদ্ধা হওয়া যায় না। মুক্তিযোদ্ধা হতে হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অধিকারী হতে হবে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অধিকারী হতে হলে বিশেষ গোষ্ঠী বা বিশেষ দলের সাথে গাঁটছড়া বাঁধতে হবে। এসব কারণে, তাদের মতে, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারদের কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধা হতে পারেননি, কেননা সেই বিশেষ গোষ্ঠী বা দলের অন্তর্ভুক্ত তারা হতে পারেননি।

 

ইতিহাস সচেতনতা আমাদের তেমন প্রখর নয়। স্মৃতির ধারণক্ষমতাও তেমন সুদৃঢ় নয়। এসব কারণে মাঝে মধ্যে ভীতসন্ত্রস্ত হই। সিরাজউদ্দৌলা বিদেশী বেনিয়াদের যতটুকু ঘৃণা করতেন, মীর কাশেমের ঘৃণাও ছিল তেমনি। কিন্তু ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভ যে সম্ভব নয়, তা অনুধাবনে দুয়ের মধ্যে পার্থক্য ছিল আকাশ-পাতাল। এজন্য দুইজনকেই পরাজয়ের গ্লানি নিয়েই নিঃশেষ হতে হয়। কেউ পাননি বিজয়ের আস্বাদ। আমরা কিন্তু ১৬ ডিসেম্বরকে ধরে রাখতে চাই।

 

বিজয় দিবসের মূল তাৎপর্য হলো ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে জাতির উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ভাবনাকে ধারণ করা এবং অগ্রগতির শতপথকে নির্বিঘ্ন করে তোলা যেন কোনো অপরিণামদর্শী চিন্তা বা উচ্চারণ বা কর্ম জাতীয় ঐক্যে ভাঙন ধরাতে সক্ষম না হয়। বিজয় দিবসের তাৎপর্য হলো এই ঐতিহাসিক বিজয়কে দেশের বৃহত্তর জনসমষ্টির নিকট অর্থপূর্ণ করে তোলা। প্রতি মুহূর্তে স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, এই বিজয় সমগ্র জাতির বিজয়। কোনো ব্যক্তি বা কোনো গোষ্ঠী বা কোনো দলের বিজয় নয়। এই সত্যে বিকৃতি ঘটানোর স্পর্ধা যেন কারো না হয়।

 

বিজয় দিবসে ভাবতে হবে দেশের কোটি কোটি মানুষের কথা, তাদের চিন্তাভাবনা, তাদের আশা-আকাক্সক্ষার কথা। তাদের দুঃখ-বেদনার কথা। তাদের বঞ্চনার কথা। গত বছরগুলোতে যেভাবে সর্বগ্রাসী ব্যর্থতা আমাদের আড়ষ্ট করে রেখেছিল তার গ্লানি থেকে মুক্ত হওয়ার কথা। আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ স্বার্থকভাবে মোকাবেলা করার কথা। দলীয় মানসিকতার নোংরা নর্দমা থেকে মুক্ত হয়ে সমগ্র সমাজব্যাপী বলিষ্ঠ জীবনবোধ প্রতিষ্ঠার কথা।

 

একাত্তরের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার প্রকাশ ঘটে এই জাতির সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণ, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্ত এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সুশাসন ও স্বশাসনের আশীর্বাদ দেশের প্রত্যেকের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়ার দৃঢ়সঙ্কল্পে। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি হলো সমগ্র জাতি। সমগ্র জাতিই এক দীর্ঘ জীবন-মরণ সংগ্রামে বিজয়ের লাল গোলাপটি ছিনিয়ে এনে ১৬ ডিসেম্বরে এই জাতির জন্য রক্তসিক্ত পতাকা সগৌরবে স্থাপন করেছে। ১৬ ডিসেম্বর আমাদের জাতীয় অস্তিত্বের ঠিকানা। আমাদের গৌরবময় অর্জনের প্রকৃষ্ট নিদর্শন। কখনো যেন আমরা একথা ভুলে না যাই।

 

পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের দলিল

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী, আত্মসমর্পনের দলিলে জেনারেল জগজিত সিং অরোরার সামনে সই করছেন।

 

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পনের দলিলে ডিসেম্বর ১৬ ,১৯৭১ বাংলাদেশ সময় বিকাল ৪.৩১ মিনিটে ঢাকার রমনা রেস কোর্স ময়দানে জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী সই করেন।

 

পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের দলিল তিন প্রস্থে প্রস্তুত করা হয়েছিল। একটি প্রস্থ ভারত সরকার এবং দ্বিতীয় প্রস্থ পাকিস্তান সরকারের নিকট সংরক্ষিত আছে। বাংলাদেশ সরকারের প্রাপ্য দলিলটি বাংলাদেশে নেই।

 

যে টেবিলে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষরিত হয়েছিল তা ঢাকা ক্লাব থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। এই টেবিলটি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের ৩৭ সংখ্যক প্রদর্শনী কক্ষে সংরক্ষিত আছে। পরিপ্রেক্ষিত :

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ শাসিত ভারত বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি স্বাধীন দেশের জন্ম হয়। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় অংশের নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা শুরু করে। অতঃপর জনযুদ্ধের আদলে মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা ঘটে।

 

মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণে ক্রমান্বয়ে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর অবস্থা এতটাই শোচনীয় হয়ে পড়ে যে উপায়ন্তর না দেখে ঘটনা ভিন্ন খাতে পরিচালিত করতে তারা ডিসেম্বরের ৩ তারিখ ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এতে ভারতের প্রধান মন্ত্রী বলেন যে “বাংলাদেশে যে যুদ্ধ চলে আসছিল তা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরিণত হয়েছে।” ভারতের সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সাথে যুক্ত হয়ে যৌথবাহিনী তৈরি করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে।

 

৪ঠা ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে ভারতীয় স্থলবাহিনীর সম্মুখ অভিযান শুরু হয় চারটি অঞ্চল থেকে:

 

(১) পূর্বে ত্রিপুরা রাজ্য থেকে তিন ডিভিশনের সমবায়ে গঠিত ৪র্থকোর সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-কুমিল্লা-নোয়াখালী অভিমুখে;

(২) উত্তরাঞ্চল থেকে দু’ডিভিশনের সমবায়ে গঠিত ৩৩তম কোর রংপুর-দিনাজপুর-বগুড়া অভিমুখে;

(৩) পশ্চিমাঞ্চল থেকে দু’ডিভিশনের সমবায়ে গঠিত ২য় কোর যশোর-খুলনা-কুষ্টিয়া-ফরিদপুর অভিমুখে; এবং

(৪) মেঘালয় রাজ্যের তুরা থেকে ডিভিশন অপেক্ষা কম আর একটি বাহিনী জামালপুর-ময়মনসিংহ অভিমুখে।

 

যৌথবাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে সারা দেশের সীমান্তবর্তী যুদ্ধক্ষেত্রগুলো থেকে পাকিস্তানীরা পিছু হটতে শুরু করে। একের পর এক পাকিস্তানী ঘাঁটির পতন হতে থাকে। পাকিস্তানীরা অল্প কিছু জায়গায় তাদের সামরিক শক্তি জড় করেছিল; যৌথবাহিনী তাদের এড়িয়ে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ঢাকার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।

 

বাংলাদেশের আপামর জনতাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় এগিয়ে আসে। আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণার মাত্র ১৩ দিনের মাথায় যৌথবাহিনী ঢাকার দোরগোড়ায় পৌঁছে যায়। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণের মুখে ইতোমধ্যে পর্যদুস্ত ও হতোদ্যম পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তান ৯৩,০০০ হাজার সৈন্যসহ আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। স্বাক্ষরিত হয় আত্মসমর্পণের দলিল। এরই মাধ্যমে নয় মাস ব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের অবসান হয়; প্রতিষ্ঠিত হয় বাঙ্গালী জাতির প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ।

 

আত্মসমর্পণ দলিলের ভাষ্য আত্মসমর্পণ দলিলের লেখা এখন বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং ভারত সরকারের পাবলিক সম্পত্তি এবং এটি দিল্লি জাতীয় যাদুঘর প্রদর্শনের জন্য রাখা আছে (জানুয়ারি ২০১২ হিসাবে)। দলিলের লেখা ইংরেজিতে ছিল এবং তা হল:

 

এগুলো অবশ্যই পড়ুন—

The PAKISTAN Eastern Command agree to surrender all PAKISTAN Armed Forces in BANGLA DESH to Lieutenant-General JAGJIT SINGH AURORA, General Officer Commanding in Chief of Indian and BANGLA DESH forces in the Eastern Theater. This surrender includes all PAKISTAN land, air and naval forces as also all para-military forces and civil armed forces. These forces will lay down their arms and surrender at the places where they are currently located to the nearest regular troops under the command of Lieutenant-General JAGJIT SINGH AURORA.

 

The PAKISTAN Eastern Command shall come under the orders of Lieutenant-General JAGJIT SINGH AURORA as soon as the instrument has been signed. Disobedience of orders will be regarded as a breach of the surrender terms and will be dealt with in accordance with the accepted laws and usages of war. The decision of Lieutenant-General JAGJIT SINGH AURORA will be final, should any doubt arise as to the meaning of interpretation of the surrender terms.

 

Lieutenant-General JAGJIT SINGH AURORA gives a solemn assurance that personnel who surrender shall be treated with dignity and respect that soldiers are entitled to in accordance with provisions of the GENEVA Convention and guarantees the safety and well-being of all PAKISTAN military and para-military forces who surrender. Protection will be provided to foreign nationals, ethnic minorities and personnel of WEST PAKISTANI origin by the forces under the command of Lieutenant-General JAGJIT SINGH AURORA.

 

signed

(JAGJIT SINGH AURORA)

 

Lieutenant-General General Officer Commanding in Chief India and BANGLA DESH Forces in the Eastern Theatre 16 December 1971 signed (AMIR ABDULLAH KHAN NIAZI) Lieutenant-General Martial Law Administrator Zone B and Commander Eastern Command (Pakistan) 16 December 1971

 

অনুবাদ:

পূর্ব রণাঙ্গনে ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ, লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানের সকল সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে আত্মসমর্পণে সম্মত হলো। পাকিস্তানের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীসহ সব আধা-সামরিক ও বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষেত্রে এই আত্মসমর্পণ প্রযোজ্য হবে। এই বাহিনীগুলো যে যেখানে আছে, সেখান থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কর্তৃত্বাধীন নিয়মিত সবচেয়ে নিকটস্থ সেনাদের কাছে অস্ত্রসমর্পণ ও আত্মসমর্পণ করবে।

 

এই দলিল স্বাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড লেফটেন্যান্ট-জেনারেল অরোরার নির্দেশের অধীন হবে। নির্দেশ না মানলে তা আত্মসমর্পণের শর্তের লঙ্ঘন বলে গণ্য হবে এবং তার প্রেক্ষিতে যুদ্ধের স্বীকৃত আইন ও রীতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আত্মসমর্পণের শর্তাবলীর অর্থ অথবা ব্যাখ্যা নিয়ে কোনো সংশয় দেখা দিলে, লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত।

 

লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আত্মসমর্পণকারী সেনাদের জেনেভা কনভেনশনের বিধি অনুযায়ী প্রাপ্য মর্যাদা ও সম্মান দেওয়ার প্রত্যয় ঘোষণা করছেন এবং আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানি সামরিক ও আধা-সামরিক ব্যক্তিদের নিরাপত্তা ও সুবিধার অঙ্গীকার করছেন। লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার অধীন বাহিনীগুলোর মাধ্যমে বিদেশি নাগরিক, সংখ্যালঘু জাতিসত্তা ও জন্মসূত্রে পশ্চিম পাকিস্তানি ব্যক্তিদের সুরক্ষাও দেওয়া হবে।

 

স্বাক্ষর করেন

(জগজিৎ সিং অরোরা )

 

লেফটেন্যান্ট-জেনারেল

জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ

পূর্ব রণাঙ্গনে ভারত ও বাংলা দেশ যৌথ বাহিনী

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১

 

স্বাক্ষর করেন

(আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি)

লেফটেন্যান্ট-জেনারেল সামরিক আইন প্রশাসক অঞ্চল

বি অধিনায়ক পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড (পাকিস্তান)

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১